নিম পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা জেনে নিন

নিম গাছ আমাদের কাছে খুবই পরিচিত একটি ওষধি গাছ হলেও নিম পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আমরা অনেকেই জানি না। শত শত বছর ধরে আয়ুর্বেদ, ইউনানি এবং লোকজ চিকিৎসার মতো সুপ্রাচীন চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই নিম পাতা। নিম গাছের পাতা, ছাল, ফুল, ফল ও তেল সহ প্রায় সব উপাদানকেই বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার ক্রা হয় ভারতীয় উপমহাদেশে। বিশেষ করে নিম গাছের পাতা বা নিম পাতা তার অসাধারণ অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিফাঙ্গাল এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণের কারণে আমাদের প্রত্যাহিক জীবনে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে! জ্ঞানী বাবা!’র আজকের আর্টিকেলে নিম পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা বিষয়ক সমস্ত কিছু বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তো চলুন, শুরু করা যাক!
সূচীপত্রঃ
নিম পাতার উপকারিতা
১. চর্ম রোগ প্রতিকার করতে পারে
আপনার ত্বকের সমস্যার জন্য নিম পাতা হতে পারে অত্যন্ত উপকারী ও কার্যকরী সমাধান। নিম পাতায় থাকা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান আমাদের ত্বকের ব্রণ, ফুসকুড়ির মতো অন্যান্য সংক্রমণ প্রতিরোধে অনেক উপকারী ভূমিকা পালন করতে পারে। নিয়মিত নিম পাতার রস বা নিম পাতার তেল মুখে ব্যবহার করলে ব্রণ কমে এবং তার সাথে ত্বকও উজ্জ্বল হয়। তাছাড়া নিম পাতা আমাদের ত্বকের অতিরিক্ত তেল শোষণ করে আমাদের ত্বকের অতিরিক্ত তৈলাক্ততা দূর করতে সাহায করে।
আরও পড়ুনঃ লেবুর উপকারিতা ও অপকারিতা জেনে নিন
২. চুলের যত্নে বেশ উপকারি
ত্বকের মতো নিম পাতা চুলের জন্যও অত্যন্ত উপকারী । নিম পাতায় থাকা অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান চুলের খুশকি দূর করতে দারুণ সহায়তা করে। নিম পাতা পানিতে ফুটিয়ে নিয়মিত সেই পানি দিয়ে চুল ধুতে পারেন, এতে আপনার মাথার ত্বক পরিষ্কার থাকবে এবং চুলের গোড়া মজবুত হবে। নিয়মিত নিম পাতার ব্যবহার চুল পড়া কমায় এবং নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে।
৩. মুখের স্বাস্থ্য ও ডেন্টাল কেয়ারে নিম পাতা
নিমের গাছের ডাল প্রাচীনকাল থেকেই প্রাকৃতিক টুথব্রাশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নিমের ডাল দাঁতের মাড়ি শক্ত করে ও দাঁতের ক্ষয় রোধ করে এমনি মুখের দুর্গন্ধ দূর করতেও সাহায্য করে। নিমের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান দাঁতের ক্যাভিটি ও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ প্রতিরোধে বেশ কার্যকর। বর্তমানে অনেক দাঁতের পেস্টেই নিমের পেস্ট ব্যবহার করা হয়।
আরও পড়ূনঃ কত ডিগ্রি জ্বর হলে মানুষ মারা যায় জানেন কি?
৪. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
আপনি জেনে অবাক হবেন, নিম পাতার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণাগুণ আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। নিম পাতা শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে এবং বিভিন্ন সংক্রামক রোগ থেকে দেহকে রক্ষা করে। নিয়মিত নিম পাতার রস সেবন করলে তা আপনার জন্যে ভাইরাল ফিভার (ভাইরাস জনিত জ্বর), ঠান্ডা, স্বর্দি-কাশিসহ অন্যান্য অনেক রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।
৫. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
নিম পাতা দেহের রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিম পাতা দেহের ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে, যা টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অনেক উপকারী। নিয়মিত নিম পাতা সেবন করলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকে এবং ধীরে ধীরে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা কমাতে সাহায করে। আপনি আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিদিন সকালে খালি পেটে নিম পাতার রস পান করতে পারেন, এটি আপনার রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভুমিকা রাখবে।
৬. লিভারের জন্য উপকারী
নিম পাতা লিভারের কার্যকারিতা বাড়াতে সহায়তা করে। এটি লিভারকে শরীরে উৎপন্ন বিষাক্ত পদার্থ থেকে মুক্ত রাখতে সাহায্য করে এবং হেপাটাইটিসসহ লিভারের নানান সমস্যার ঝুঁকি কমায়। যাদের ফ্যাটি লিভারের সমস্যাইয় রয়েছেন, তাদের জন্য নিম পাতা বিশেষভাবে কার্যকর হতে পারে। নিয়মিত (পরিমাণ মত) নিম পাতার রস সেবন করলে লিভারের কর্মক্ষমতা ভালো থাকে এবং হজম প্রক্রিয়াও সহজ হয়।
আরও পড়ুনঃ সেরা ১৫ টি দ্রুত ওজন কমানোর উপায়…
৭. ত্বকের ক্ষত নিরাময় করতে পারে
নিম পাতায় প্রাকৃতিকভাবে অ্যান্টিসেপটিক উপাদান রয়েছে, যা দ্রুত ত্বকের ক্ষত শুকাতে সাহায্য করে। কাটা-ছেঁড়া, পুড়ে যাওয়া বা বিভিন্ন চর্মরোগে নিম পাতা ব্যবহার করলে দ্রুত আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। ত্বকের সংক্রমণের ঝুঁকি কমানোর জন্য নিম পাতা ফুটিয়ে সেই পানি দিয়ে ক্ষতস্থানে ব্যবহার করতে পারেন। এটি আপনার ত্বককে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে রক্ষা করবে।
৮. হজমশক্তি বৃদ্ধি করে
নিম পাতা আমাদের হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তাছাড়া গ্যাস, বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্যের মত সমস্যা দূর করতেও বেশ কার্যকর নিম পাতা। নিম পাতায় থাকা তেতো উপাদান পাকস্থলি পরিষ্কার রাখে এবং পেটের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে। আবার পেটের কৃমি দূর করতেও নিম পাতার ব্যবহার একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। আপনি আপনার প্রয়োজন অনুসারে নিয়মিত নিম পাতার রস বা শুকনো নিম পাতা গুঁড়া খেয়ে পারেন, এটি আপনার পাকস্থলিকে পরিষ্কার ও সুস্থ রাখবে।
আরও পড়ুনঃ প্রতিদিন ১ কেজি করে ওজন কমাতে চান? পড়ূন বিস্তারিত…
নিম পাতার অপকারিতা

নিম পাতা আমাদের ত্বকের জন্যে অনেক উপকারি হলেও নিম পাতার কিছু নেতিবাচক দিক বা অপকারিতাও আছে। একটা কথা আছে না “অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়”, তেমনি নিম পাতার অতিরিক্ত ব্যবহারও আপনার শরীরের মারাত্বক ক্ষতি করতে পারে। নিম পাতার অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে আপনার হজম সমস্যা থেকে শুরু করে কিডনি এমনকি লিভারের সমস্যা পর্যন্ত হতে পারে! নিচে ধারাবাহিকভাবে অতিরিক্ত নিম পাতার ব্যবহারের কিছু অপকারিতা তুলে ধরা হলোঃ
১. হজমে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে
নিম পাতার তেতো স্বাদ অনেকের জন্যই সহ্য করা অনেক কঠিন হতে পারে। বিশেষ করে, একসাথে নিম পাতার যদি অনেক বেশি পরিমাণে গ্রহণ করা হয়, তাহলে তা আপনার পেটে অস্বস্তি, গ্যাস্ট্রিক বা বদহজমের মতো সমস্যার কারণ হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত নিম পাতার রস পেট ব্যথা এমনকি ডায়রিয়ার কারণও হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অতিরিক্ত নিম পাতার রস সেবন কখনোই উচিত নয়।
২. রক্তচাপ কমিয়ে দিতে পারে
নিম পাতার মধ্যে থাকা নানা উপাদান আপনার রক্তচাপও কমিয়ে দিতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য এটি উপকারী হলেও, যাদের রক্তচাপ কম তাদের জন্য এটি মারাত্বক ক্ষতিকর হতে পারে। নিম পাতা বেশি পরিমাণে গ্রহণ করলে হঠাৎ রক্তচাপ অনেক কমে যেতে পারে, যা মাথা ঘোরা, শারিরীক দুর্বলতা বা অজ্ঞান হওয়ার কারণ হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ ১০৩ ডিগ্রি জ্বর হলে করণীয় কি? জেনে নিন বিস্তারিত…
৩. গর্ভবতীদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে
গর্ভবতী নারীদের জন্য নিম পাতা বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ এটি জরায়ুর সংকোচন ঘটিয়ে গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বিশেষ করে গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে নিম পাতা বা এর রস সেবন করা উচিত নয়। একইভাবে, স্তন্যদানকারী মায়েদের ক্ষেত্রেও এটি ক্ষতিকর হতে পারে, কারণ নিমের কিছু উপাদান বুকের দুধের মাধ্যমে শিশুর শরীরে প্রবেশ করতে পারে এবং তার স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
৪. লিভারের ক্ষতি করতে পারে
যদিও নিম পাতা লিভারের জন্য অনে উপকারী , তবে অতিরিক্ত নিম পাতার ব্যবহারে তা লিভারের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে, যদি দীর্ঘ সময় ধরে নিয়মিত নিম পাতা খাওয়া হয়, তাহলে লিভারের স্বাভাবিক কার্যকারিতায় সমস্যা দেখা দিতে পারে। অতিরক্ত নিম পাতার ব্যবহারে লিভার এনজাইমের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে, যা লিভারের স্বাভাবিক কার্যপ্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে। তাই নিম পাতার অতিরিক্ত ব্যবহার থেকে সাবধান!
৫. কিডনির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে
দীর্ঘদিন নিম পাতার অতিরিক্ত ব্যবহার কিডনির জন্যও মারাত্বক ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। নিম পাতা শরীর থেকে টক্সিন বের করতে সাহায্য করে যা মূলত উপকারি তবে নিয়মিত অতিরিক্ত পরিমাণে নিম পাতা গ্রহণ করলে তা কিডনির কার্যকারিতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে নিম পাতা বা নিমের রস সেবন করলে কিডনি সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে । এক পর্যায়ে কিডনি দুর্বল হয়ে গেলে শরীরে বিষাক্ত পদার্থ জমতে থাকবে, যা পরবর্তীতে আপনার দেহে নানান স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
আরও পড়ুনঃ সেরা ১০ টি দ্রুত হাই প্রেসার কমানোর উপায়
৬. শিশুদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে
শিশুদের জন্য নিম পাতার রস ক্ষতিকর হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, নবজাতক বা একদম ছোট বাচ্চাদের নিম পাতার রস খাওয়ানো হলে বমি, ডায়রিয়া, খিঁচুন এমনকি মারাত্মক পর্যায়ে গেলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। শিশুদের শরীর খুবই সংবেদনশীল হওয়ায় নিমের তীব্র উপাদানগুলো তাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তাই শিশুদের নিম পাতার রস সেবন করানোর আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৭. হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলতে পারে
নিম পাতায় থাকা কিছু উপাদান হরমোনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। নিম পাতা দেহের টেস্টোস্টেরন এবং ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে, যা আপনার প্রজনন-স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আলাদা করে, পুরুষদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত নিম পাতার ব্যবহার শুক্রাণুর সংখ্যা কমিয়ে দিতে পারে। আবার নারীদের ক্ষেত্রে মাসিক চক্রের অসামঞ্জস্যতাও সৃষ্টি করতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে নিম পাতার সেবন নারীদের সন্তান ধারণের ক্ষমতা কমিয়ে ফেলতে পারে বলে মনে করেন গবেষকরা।
আরও পড়ুনঃ সেরা ১০ টি কিডনি ভালো রাখার উপায়
শেষ কথা
সবশেষে, আশা করি নিম পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে পাঠক বিস্তারিত জানতে পেরেছেন জ্ঞানী বাবা!’র আজকের আর্টিকেল থেকে। জ্ঞানী বাব!’র আজকের আর্টিকেলটি যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে আপনার পরিচিতদের সাথে ব্লগটি শেয়ার করুন। আর কমেন্ট করে আপনার অনুভূতি জানাতে ভুলবেন না কিন্তু!!!