কত ডিগ্রি জ্বর হলে মানুষ মারা যায় জানেন কি?

আমরা অনেকেই জানিনা কত ডিগ্রি জ্বর হলে মানুষ মারা যায় কিংবা কত ডিগ্রি জ্বর হলে তা আশংকাজনক হয়ে যেতে পারে যেখানে জ্বর আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধের একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া মাত্র । আমাদের দেহে সাধারণত কোনো সংক্রমণের বিরুদ্ধে শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে জ্বর হতে দেখা যায় । যেটাকে আমরা জ্বর বলি সেই প্রক্রিয়াতা আসলে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ানোর মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সক্রিয় করে তোলে। সাধারণভাবে জ্বর সতর্ককারী হলেও কিছু ক্ষেত্রে জ্বর অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে ওঠতে পারে। বিশেষ করে শরীরের তাপমাত্রা যখন ১০৩°F বা তার বেশি ছাড়িয়ে যায়। অতি উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা ব্যাহত করে শরীরের দীর্ঘমেয়াদী মারাত্মক ক্ষতি করে ফেলতে পারে।
আরো পড়ুনঃ সেরা ১৫ টি দ্রুত ওজন কমানোর উপায় জেনে নিন…
যখন শরীরের তাপমাত্রা কোনো কারণে ১০৫°F বা তার বেশি চলে যায়, তখন তা রোগীর জীবনের ঝুকি পর্যন্ত বাড়িয়ে ফেলতে পারে। এমন আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না হলে তা রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।
জ্ঞানী বাবা!‘র আজকের এই আর্টিকেলে আমরা জানব, জ্বর কী? জ্বর কেন হয়? থেকে শুরু করে কত ডিগ্রি জ্বর হলে তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠতে পারে কিংবা কত ডিগ্রি জ্বর হলে মানুষ মারা যায়, এবং কিভাবে এ ধরনের ভয়ানক জ্বর থেকে সুরক্ষিত থাকা যায়? বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা। তো চলুন, শুরু করা যাক!!!
সূচীপত্রঃ
জ্বর কী? কেন আমাদের জ্বর হয়?
কত ডিগ্রি জ্বর হলে মানুষ মারা যায়? জানার আগে আমাদের জানতে হবে জ্বর আসলে কী? একদম সাধারণভাবে বললে, জ্বর হল আমাদের শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি অংশ মাত্র। সাধারণত শরীরকে বিভিন্ন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্যে আমাদের শরীরে আকস্মিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, যাকে আমরা জ্বর বলে চিনি। যখন আমাদের শরীরে কোনো ইনফেকশন হয়, তখন ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা) আমাদের মস্তিষ্কে কিছু রাসায়নিক সংকেত পাঠায়, যা আমাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশকে শরীরের তাপমাত্রা বাড়াতে বলে। ফলে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায় আর আমরা সেটাকেই জ্বর বলি।
আরও পড়ুনঃ কম্পিউটার ভাইরাস কি? ১০ টি কম্পিউটার ভাইরাসের নাম
আমরা অনেকেই জ্বরকে একটি রোগ ভেবে ভুল করি। জেনে অবাক হবেন, জ্বর মূলত অন্য কোনো রোগের উপসর্গ, নিজে কোনো রোগ নয়। জ্বর সাধারণত ফ্লু, ঠান্ডা-সর্দি, টনসিল ইনফেকশন, নিউমোনিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, বা এমন অন্যান্য ভাইরাল ও ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের কারণে দেখা দিতে পারে। কখনো কখনো শরীরের পানি শূন্যতা (ডিহাইড্রেশন)কিংবা কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও জ্বর দেখা দিতে পারে।
আমাদের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা সাধারণত ৯৭°F থেকে ৯৯°F এর মধ্যেই থাকে। শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা এর বেশি হলেই তাকে জ্বর হিসেবে ধরা হয়।
দেহের তাপমাত্রা অনুসারে জ্বরের শ্রেণিবিন্যাস
জ্বরকে সাধারণত দেহের তাপমাত্রার উপর ভিত্তি করে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারেঃ
- শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা: ৯৭°F – ৯৯°F (এই অবস্থাকে জ্বর ধরা হয়না)
- মৃদু জ্বর: ৯৯°F – ১০১°F (সাধারণ ফ্লু বা ঠান্ডার কারণে এ ধরণের জ্বর দেখা যায়)
- মাঝারি জ্বর: শরীরের তাপমাত্রা ১০১°F – ১০৩°F (ভাইরাল সংক্রমণের কারণে সাধারণত এ ধরণের জ্বর দেখা যায়)
- উচ্চ জ্বর: শরীরের তাপমাত্রা ১০৩°F – ১০৫°F (গুরুতর সংক্রমণ অথবা জটিল কোনো রোগের ইঙ্গিত হিসেবে এ ধরণের জ্বর দেখা যায়)
- গুরুতর জ্বর: শরীরের তাপমাত্রা ১০৫°F বা তার বেশি হলে (এত উচ্চ জ্বর রোগীর জণ্যে বিপজ্জনক হতে পারে , যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত)
শরীরের তাপমাত্রা ১০৫°F-এর বেশি হয়ে গেলে শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন মস্তিষ্ক, হার্ট, কিডনি ও লিভার মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে তাপমাত্রা ১০৭-১০৮°F ছাড়িয়ে গেলে রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে। তাই এ ধরণের উচ্চমাত্রার জ্বর হলে অতি দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
আরো পড়ুনঃ নিম পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা
কত ডিগ্রি জ্বর হলে মানুষ মারা যায় ?
যদিও জ্বর স্বাভাবিকভাবে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থারই একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তবে যখন জ্বরের মাত্রা ১০৩°F বা তার চেয়েও বেশি হয়ে যায়, তখন তা রোগীর জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এমনকি রোগীর জীবন নাশের ঝুঁকিও বাড়িয়ে ফেলতে পারে। তাই এসব ক্ষেত্রে সাবধান!
১০৫°F বা তার চেয়ে বেশি হয়ে গেলে কি হতে পারে?
- এত উচ্চ তাপমাত্রায় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারবে না।
- মস্তিষ্কের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, ফলে স্নায়ুবিক সমস্যা দেখা যেতে পারে।
- অতিরিক্ত তাপের কারণে শরীর পানিশূন্য হয়ে যেতে পারে, ফলে কিডনি ও হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতায় ব্যাঘাত ঘটবে।
- শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে ১০৫°F তাপমাত্রা খিঁচুনি বা অজ্ঞান হওয়ার মতো জটিলতারও সৃষ্টি করতে পারে।
তাপমাত্রা ১০৬-১০৭°F বা তার চেয়ে বেশি হয়ে গেলে কী হতে পারে?
- তাপমাত্রা ১০৬-১০৭°F বা তার চেয়ে বেশি হয়ে গেলে আমাদের স্বাভাবিক স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা ব্যাহত হবে, যার ফলে রোগীর মানসিক বিভ্রান্তি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, এমনকি কোমায় চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে।
- এত উচ্চ তাপমাত্রায় আমাদের শরীরের প্রোটিন ও এনজাইম গুলো ধ্বংস হতে শুরু করে, ফলে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলোর স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
কত ডিগ্রি জ্বর আশঙ্কাজনক? কত ডিগ্রি জ্বর হলে মানুষ মারা যায় ?
সাধারণত শরীরের তাপমাত্রা ১০৭-১০৮°F (৪১.৫-৪২°C) বা এর চেয়ে বেশ হয়ে গেলে তা রোগীর জন্য প্রাণঘাতীও হয়ে উঠতে পারে।
১০৭-১০৮°F তাপমাত্রায় কী ঘটে?
- মস্তিষ্কের কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যেতে শুরু করবে, যার ফলে রোগীর স্নায়বিক রোগের কারণ হতে পারে।
- রক্তচলাচল ব্যাহত হয়ে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
- শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো স্বাভাবিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে, যার ফলে রোগী কোমায় চলে যেতে পারে।
- শরীরের একাধিক অঙ্গ বিকল হয়ে গেলে রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে।
বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ, ও যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তাদের জন্য এত উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে। তাই ১০৪°F বা তার বেশি তাপমাত্রার জ্বর হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
জ্বরের কারণে সম্ভাব্য মৃত্যুর কারণ

জ্বরের কারণে শরীরের তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেলে তা রোগীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। অতি জ্বরের কারণে রোগী মারা যাওয়ার বেশ কিছু কারণ নিচে তুলে ধরা হলোঃ
হাইপারথার্মিয়া (Extreme Heat Stroke)
যখন শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক তাপমাত্রার সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন আমাদের দেহে দেখা দেয় হাইপারথার্মিয়া (শরীরের অতিরিক্ত তাপমাত্রা)। ফলে আমাদের মস্তিষ্কের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত হয়। শরীর অতিরিক্ত তাপ গ্রহণ করতে না পেরে এক সময় দেহের কোষের ক্ষতি হতে শুরু করে, ফলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।
আরো পড়ুনঃ প্রতিদিন ১ কেজি করে দ্রুত ওজন কমানোর উপায় খুঁজছেন?
ইনফেকশন বা সেপসিস
অতি উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর সাধারণত শরীরের কোন ইনফেকশনের কারণে হয়। বিশেষ করে সেপসিস (Blood Infection) রোগীর মৃত্যু ঝুঁকির পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। এই ইনফেকশন যখন শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, তখন শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলোর কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে শুরু করে। সেপসিসের কারণে লিভার, কিডনি এমনকি হার্টের কার্যকারিতাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে!
মস্তিষ্কের ক্ষতি
উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর অনেক সময় ধরে থাকলে, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যকারিতাইয় বিঘ্ন ঘটে। ফলে রোগীর ক্ষেত্রে কনফিউশন, হ্যালুসিনেশন, খিঁচুনি, বা কোমায় চলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটতে পারে। তাছাড়া অনেক সময় অতিরিক্ত তাপমাত্রার ফলে হৃদযন্ত্রের ওপরও মারাত্বক চাপ সৃষ্টি হতে পারে যা রোগীর মৃত্যুও ঘটাতে পারে। তাই জটিলতা এড়াতে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।
জ্বর থেকে সুরক্ষিত থাকার উপায়
অতি উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর থেকে রক্ষা পেতে কিছু সতর্কতা অনুসরণ করা জরুরি। চলুন জেনে নেই…
পানি ও তরল খাবার
জ্বরের সময় প্রচুর পানি পান করুন। শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পর্যাপ্ত তরল খাওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যখন শরীরে পানির ঘাটিতি দেখা দেয়। জ্বরের সময় ডাবের পানি, লেবুর শরবত বা স্যুপ খাওয়াও বেশ কার্যকর হতে পাড়ে।
শরীর ঠান্ডা রাখুন
জ্বরের সময় রোগীর শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে, কুসুম গরম পানি দিয়ে গা মুছুন বা স্পঞ্জিং করুন। বরফ বা খুব ঠান্ডা পানি ব্যবহার না করাই ভালো। কেননা এতে রোগী শক খেতে পারেন।
বিশ্রাম:
জ্বরে আক্রান্ত হলে প্রচুর বিশ্রাম নিন, যাতে শরীর দ্রুত সেরে উঠতে পারে।
- কোনো গুরুতর লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
যদি জ্বর ১০৩°F বা তার বেশি হয়ে যায়, অথবা কোনো গুরুতর লক্ষণ (খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট, মানসিক বিভ্রান্তি) দেখা দেয়, তখন অতি দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
টিকা গ্রহণ:
অনেক ধরনের ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত জ্বরের প্রতিষেধক হিসেবে টিকা দেয়া হয়। যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু, টাইফয়েড ইত্যাদি। সময় মতো টিকাগুলো গ্রহণ করলে সেই সমস্ত ভাইরাল জ্বর থেকে সুরক্ষিত থাকা যায়।
শেষ কথা
সবশেষে এটাই বলব, জ্বর কোন রোগ নয়। জ্বর অন্য রোগের উপসর্গ কেবল। তবে সচেতনতার অভাবে কিংবা ভাইরাসজনিত কারণে কখনো কখনো জ্বর অনেক মারাত্বক হয়ে যেতে পারে। তাই যেকোন প্রকার জ্বরকেই একদম অবজ্ঞা করা ঠিক নয়। সময় ও অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে পারলে যেকোনো প্রকার জ্বর থেকেই সহজে সুরক্ষিত থাকা সম্ভব।
আশা করি জ্ঞানী বাবা!‘র আজকের আর্টিকেলটি পাঠকের কিছুটা হলেও কাজে এসেছে। একটু হলেও উপাকারে এসেছে। আশা করি পাঠক আজকের আর্টিকেল থেকে বেশ ভালো করেই জানতে পেরেছেন জ্বর কী? আমাদের জ্বর কেন হয়? কত ডিগ্রি জ্বর হলে মানুষ মারা যায় ? ইত্যাদি সকল প্রশ্নের উত্তর। যদি আজকের আর্টিকেলটি ভাল লেগে থাকে তাহলে প্রিয়জনদের সাথে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করুন। আর কমেন্ট সেকশোনে আপনার মুল্যবান মন্তব্য জানাতে ভুলবেন না কিন্তু!!!