১০৩ ডিগ্রি জ্বর হলে করণীয় কি? জেনে নিন বিস্তারিত…

জ্বর শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি সাধারণ অংশ। জ্বর আমাদের দেহে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে। তবে দেহের তাপমাত্রা যখন ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি হয়ে যায়, তখন তা শরীরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। উচ্চমাত্রার জ্বর সাধারণত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে, তবে ডিহাইড্রেশন, হিটস্ট্রোক বা অন্য কারণেও আশংকাজনক জ্বর দেখা দিতে পারে। জ্ঞানী বাবা!’র আজকের আর্টিকেলে আপনারা জানবেন ১০৩ ডিগ্রি জ্বর কি?, কেন ১০৩ ডিগ্রি জ্বর হয় থেকে শুরু করে ১০৩ ডিগ্রি জ্বর হলে করণীয় কি সহ সকল প্রশ্নের উত্তর । তো চলুন, শুরু করা যাক!!!
সূচীপত্রঃ
জ্বর কী? কেন আমাদের জ্বর হয়?
একদম সাধারণভাবে বললে, জ্বর হল আমাদের শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি অংশ মাত্র। সাধারণত শরীরকে বিভিন্ন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্যে আমাদের শরীরে আকস্মিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, যাকে আমরা জ্বর বলে চিনি। যখন আমাদের শরীরে কোনো ইনফেকশন হয়, তখন ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা) আমাদের মস্তিষ্কে কিছু রাসায়নিক সংকেত পাঠায়, যা আমাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশকে শরীরের তাপমাত্রা বাড়াতে বলে। ফলে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায় আর আমরা সেটাকেই জ্বর বলি।
আরও পড়ুনঃ কত ডিগ্রি জ্বর হলে মানুষ মারা যায় ?
আমরা অনেকেই জ্বরকে একটি রোগ ভেবে ভুল করি। জেনে অবাক হবেন, জ্বর মূলত অন্য কোনো রোগের উপসর্গ, নিজে কোনো রোগ নয়। জ্বর সাধারণত ফ্লু, ঠান্ডা-সর্দি, টনসিল ইনফেকশন, নিউমোনিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, বা এমন অন্যান্য ভাইরাল ও ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের কারণে দেখা দিতে পারে। কখনো কখনো শরীরের পানি শূন্যতা (ডিহাইড্রেশন)কিংবা কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও জ্বর দেখা দিতে পারে।
আমাদের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা সাধারণত ৯৭°F থেকে ৯৯°F এর মধ্যেই থাকে। শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা এর বেশি হলেই তাকে জ্বর হিসেবে ধরা হয়।
জ্বর কতটা বিপজ্জনক হতে পারে?
আগেই বলা হয়েছে জ্বর সাধারণত শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থারই একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তবে ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি হলে একে উচ্চ জ্বর হিসেবে ধরা হয়, যা কি না আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকরও হতে পারে।
উচ্চ জ্বর শিশু, বৃদ্ধ এবং বিশেষ করে যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তূলনামূলক দুর্বল, তাদের জন্য বেশি বিপজ্জনক। শিশুদের ক্ষেত্রে ১০৩ ডিগ্রি কিংবা যেকোনো উচ্চ তাপমাত্রাজনিত জ্বর খিঁচুনি (ফেব্রাইল সিজার) সৃষ্টি করতে পারে, যা শিশুর মৃত্যু ঝুকিও বাড়িয়ে ফেলতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও ১০৩ ডিগ্রি বা যোকোনো উচ্চ তাপমাত্রাজনিত জ্বর দীর্ঘসময় থাকলে শরীর পানিশূন্য হয়ে যেতে পারে এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হতে পারে।
তাছাড়া যদি উচ্চ তাপমাত্রা জনিত জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, অস্বাভাবিক দুর্বলতা, ,মানসিক বিভ্রান্তি, অবিরাম বমি বা তীব্র মাথাব্যথা দেখা দেয়, তবে ১০৩ ডিগ্রি কিংবা যেকোনো উচ্চ তাপমাত্রা জ্বরই গুরুতর সমস্যার কারণ হতে পারে। এসকল ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।
আরও পড়ুনঃ সেরা ১০ টি কিডনি ভালো রাখার উপায়
জ্বরের সাধারণ লক্ষণ ও কারণ

১০৩ ডিগ্রি জ্বর বা এরকম উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর সাধারণত বিভিন্ন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের কারণে হয়। সাধারণ সংক্রমণগুলোর মধ্যে রয়েছে ফ্লু, ঠান্ডা, নিউমোনিয়া, ইউরিন ইনফেকশন এবং ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার মতো সংক্রামক রোগ।
১০৩ ডিগ্রি বা যেকোন উচ্চ তাপমাত্রার জ্বরের সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
- শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া
- অতিরিক্ত ঘাম বা কাঁপুনি দেখা দেওয়া
- মাথাব্যথা ও শরীরে ব্যথা অনুভুত হওয়া
- দুর্বলতা ও অবসাদগ্রস্থ অনুভুত হওয়া
- ক্ষুধামন্দা দেখা যাওয়া
কখনো কখনো ডিহাইড্রেশন, হিটস্ট্রোক বা কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ইমিউন সিস্টেমের অতিসক্রিয়তার কারণেও জ্বর দেখা দিতে পারে। যদি কখনো আপনার ১০৩ ডিগ্রি কিংবা এমন উচ্চ তামত্রার জ্বর হয়, তখন জ্বরের দ্রুত কারণ চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় তৎপরতা গ্রহণ করা আবশ্যক। কোন ভাবে ব্যাপারটাকে হালকাভাবে নেবেন না কিন্তু!
১০৩ ডিগ্রি জ্বর হলে করণীয়ঃ তাৎক্ষণিক কি করবেন?
১০৩ ডিগ্রি জ্বর বা এমন যেকোনো অস্বাভাবাবিক তাপমাত্রার জ্বর হলে দ্রুত বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, যাতে রোগীর শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং শারীরিক অন্যান্য জটিলতা এড়ানো যায়।
- বিশ্রাম নিন: অতিরিক্ত কাজ বা শারীরিক পরিশ্রম থেকে বিরত থাকুন। বিশ্রাম নিলে শরীর দ্রুত সেরে ওঠবে।
- শরীর ঠান্ডা রাখুন: কুসুম গরম পানি দিয়ে গা মুছুন বা স্পঞ্জিং করুন। বরফ ঠান্ডা পানি ব্যবহার করবেন না, এতে জ্বর অবস্থায় শক লাগতে পারে।
- পানি ও তরল খাবার পান করুন: প্রচুর পানি, ডাবের পানি, ওরস্যালাইন বা লেবুর শরবত পান করুন, যাতে শরীর পানিশূন্য হয়ে না যায়।
- হালকা পোশাক পরুন: পাতলা এবং আরামদায়ক পোশাক পরুন, যাতে শরীরের তাপমাত্রা না বাড়ে এবং সহজে ঠান্ডা হতে পারে।
যদি জ্বর ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কমতে না থাকে বা শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি, বিভ্রান্তি দেখা দেয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
জ্বরে কোন খাবার ও পানীয় খাবেন?
যেকোনো জ্বর হলেই আপনার হালকা ও সহজপাচ্য খাবার খাওয়া উচিত। জ্বর সহ যেকোনো রোগের ক্ষেত্রেই দেহের হজমশক্তি তুলনামূলক দুর্বল হয়ে পড়ে ফলে ভারী খাবার সহজে হজম করতে পারেনা। তাই হালকা ও সহজপাচ্য কাহবার খান, যাতে শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় ও তার সাথে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে।
পানীয়: পানি, ডাবের পানি, গরম স্যুপ, লেবুর শরবত, ওরস্যালাইনখাবার:
- সেদ্ধ ভাত বা খিচুড়ি
- চিকেন বা সবজির স্যুপ
- সেদ্ধ ডিম (পরিমিত পরিমাণে)
- ফলের জুস (যেমন: কমলা, আপেল)
যেসকল খাবার এড়িয়ে চলবেন:
- চর্বিযুক্ত ও ভাজা-পোড়া খাবার
- ক্যাফেইন ও কার্বোনেটেড পানীয়
- অতিরিক্ত চিনি ও দুধের তৈরি ভারী খাবার
ওষুধ কখন ও কীভাবে ব্যবহার করবেন?
১০৩ ডিগ্রি জ্বর কিংবা যেকোন উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর হলে ওষুধ গ্রহণের প্রয়োজন হতে পারে, তবে তা সতর্কতার সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে ব্যবহার করতে হবে।
- প্যারাসিটামল: জ্বর কমানোর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ, সহজলভ্য ও প্রচলিত ওষুধ প্যারাসিটামল। সাধারণত ৬-৮ ঘণ্টা পরপর ৫০০ মিগ্রা প্যারাসিটামল নেওয়া যায়। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উত্তম।
- আইবুপ্রোফেন: যদি প্যারাসিটামল জ্বর কমাতে যথেষ্ট কার্যকর না হয়, তবে চিকিৎসকের অনুমতিক্রমে এই ওষধটিও ব্যবহার করা যেতে পারে।
- অ্যান্টিবায়োটিক: জ্বর যদি ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের কারণে হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী যথাসময়ে অ্যান্টিবায়োটিক নিতে হবে।
১০৩ ডিগ্রি বা যেকোন জ্বরের ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবেঃ
- ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা বিপজ্জনক হতে পারে।
- অতিরিক্ত মাত্রায় ওষুধ খাওয়া শরীরের জন্যে ক্ষতিকর হতে পারে।
- শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে ওষুধ দেওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
জ্বরের সময় কী এড়িয়ে চলা উচিত?
- গরম পোশাক ও কম্বল: অতিরিক্ত কম্বল বা গরম কাপড় জ্বর আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
- ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল: এই ধরনের পানীয় শরীরকে আরও পানিশূন্য করে তোলে। ফলে জ্বর বাড়তে পারে
- ভাজাপোড়া ও চর্বিযুক্ত খাবার: হজমে সমস্যা তৈরি করতে পারে এবং জ্বর বাড়িয়ে দিতে পারে।
- অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম: বিশ্রাম না নিলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে ও জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
জ্বর কখন গুরুতর হয়ে যেতে পারে?
১০৩ ডিগ্রি জ্বর বা যেকোনো উচ্চ তাপমাত্রাজনিত জ্বরই সাধারণত ২-৩ দিনের মধ্যে কমে আসে। তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে এটি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
যদি ৩ দিনের বেশি স্থায়ী হয়ঃ
- সাধারণ ভাইরাসজনিত জ্বর সাধারণত ২-৩ দিনের মধ্যে কমে আসে। তবে ৩ দিনের বেশি স্থায়ী হলে বা জ্বর বারবার ফিরে এলে তা কোনো সংক্রমণের ইঙ্গিত হতে পারে। তাই যথাসময়ে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিন।
বিশেষ কোনো লক্ষণ দেখা দিলে, যেমনঃ
- শ্বাসকষ্ট
- তীব্র মাথাব্যথা বা বমি
- অতিরিক্ত ক্লান্তি বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
- খিঁচুনি (বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে)
- ত্বকে লালচে দাগ বা র্যাশ
শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে সতর্কতা:
- ২ বছরের কম বয়সী শিশুদের জ্বর হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
- ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের জ্বর হলে এটি জটিল সংক্রমণের লক্ষণ হতে পারে। তাই সাবধান!
কখন হাসপাতালে যেতে হবে?
১০৩ ডিগ্রি কিংবা যেকোন জ্বরের ক্ষেত্রে যদি নিচের লক্ষণগুলো দেখা দেয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত:
- জ্বর ১০৪ ডিগ্রি বা তার বেশি হয়ে গেলে
- গুরুতর সংক্রমণের লক্ষণ থাকলে
- গলা ফুলে গেলে
- প্রস্রাবের সমস্যা দেখে দিলে
- তীব্র বুক ব্যথা অনুভুত হলে
- জ্বরের সঙ্গে শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রভাবিত হলে
হাসপাতালে যেতে হবে যদি:
- জ্বর কমানোর পরও শরীর দুর্বল হয়ে থাকে
- শ্বাসকষ্ট বা হার্টবিট অনিয়মিত হয়
- বারবার খিঁচুনি হয়
মনে রাখবেন, সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে জটিলতা এড়ানো সম্ভব। তাই ১০৩ ডিগ্রি জ্বর হোক বা না হোক যেকোনো জ্বরকেই অবহেলার চোখে দেখবেন্ না। সময় মতো যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে জ্বরের ঝুকি অনেকাংশেই এড়ানো সম্ভব।
শেষ কথা
আশা করি জ্ঞানী বাবা!’র আজকের আর্টিকেলটি থেকে পাঠক নতুন কিছু হলেও জানতে পেরেছেন। পাঠকের ব্যায় করা সময় কিছুটা হলেও কাজে লেগেছে বলে আশা করি। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে অনুরোধ করব জ্ঞানী বাবা!’র আজকের আর্টিকেলটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করবেন। আর কমেন্ট সেকশনে গিয়ে আপনার মূল্যবান মন্তব্য রেখে আসতে ভুলবেন না কিন্তু!!!