মহাকাশ রহস্য নিয়ে যে তথ্যগুলো হয়ত আপনার অজানা!

মানব সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ মহাকাশ ও মহাকাশ রহস্য নিয়ে ভেবে এসেছে। মহাকাশ কি? মহাকাশ কত বড়? মহাকাশে কি কি আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বহু যুগ যুগ ধরে। আধুনিক বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নতির ব্যাপক অগ্রগতির ফলে আমরা এখন মহাকাশ রহস্য সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি, তবে এখনো অজানা রয়ে গেছে মহাকাশ রহস্যের বড় একটা অংশ!
জ্ঞানী বাবা!’র আজকের আর্টিকেলে আমরা মহাকাশ রহস্য সম্পর্কিত বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব। “মহাকাশ কি?”, “মহাকাশে কি কি আছে ?” থেকে শুরু করে মহাকাশ কত বড়? এসকল বিষয়ের বিস্তর আলোচনা নিয়েই সাজানো হয়েছে জ্ঞানী বাবা”র আজকের আর্টিকেলটি। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!!!
সূচীপত্রঃ
মহাকাশ কি? মহাকাশ কাকে বলে? মহাকাশ রহস্য কি?

সংজ্ঞা হিসেবে বললে, মহাকাশ হলো সেই মহাজাগতিক বিস্তৃত স্থান, যেখানে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সরাসরি কোন প্রভাব নেই এবং যেখানে পৃথিবীর তুলনায় অভিকর্ষ বল তুলনামূলকভাবে কম অনুভূত হয়। সাধারণভাবে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যেখানে শেষ হয়, সেখান থেকেই মহাকাশের সীমানা শুরু বলে বিবেচনা করা হয়।
মহাকাশে বায়ুর উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে, ফলে এখানে কোন শব্দ শোনা যায়না। মহাকাশ মূলত শূন্যস্থান বা ভ্যাকুয়াম। তবে মহাকাশে নানা মহাজাগতিক বস্তু যেমন গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, ধূমকেতু এবং মহাজাগতিক রশ্মির উপস্থিতি রয়েছে।
বিজ্ঞানীরা মহাকাশের সীমানা নির্ধারণের জন্য সাধারণত “কারম্যান লাইন” (Kármán Line) ব্যবহার করে থাকেন। “কারম্যান লাইন” এর সীমানা ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) ওপরে পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সীমানার ওপরে গেলেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের প্রভাব কমে আসে এবং সেখান থেকেই আকাশকে আর আকাশ বলা হয়না। বলতে হয় মহাকাশ!
মহাকাশকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যেতে পারেঃ-
- Lower Space: পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটবর্তী অংশ, এখানেই বেশিরভাগ কৃত্রিম উপগ্রহগুলো অবস্থান করে।
- Deep Space: এখান থেকেই চাঁদ, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
- Intergalactic Space: মহাকাশের এই অংশে সকল গ্যালাক্সি, ভয়েড, ক্লাস্টার ও সুপারক্লাস্টার গুলো অবস্থান করে।
মহাকাশ কত বড়?
মহাকাশের সঠিক আকার নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব, কেননা এটি প্রতিনয়তই আরও প্রসারিত হচ্ছে। আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের ব্যাস আনুমানিক ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ (আলো এক বছরে যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে সেই দূরত্বই ১ আলোক বর্ষ, আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিতার!)। এর অর্থ এই যে, আমরা যদি আলোর গতি সম্পন্ন (আদতে তা কখনো সম্ভব নয়) কোনো যানে আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে যাত্রা শুরু করি তাহলেও মাত্র ৯ হাজার ৩০০ কোটি বছর লাগবে আমাদের মহাবিশ্বের অপর পান্তে যেতে! কল্পনা করতে পারছেন মহাকাশ কত বড় আর সুবিশাল?
কিন্তু মহাকাশ শুধুমাত্র আমাদের এই পর্যবেক্ষণযোগ্য অংশেই সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রকৃত মহাকাশ আরও অনেক বড় হতে পারে, এমনকি অনন্তও হতে পারে! বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুসারে, মহাবিশ্ব আনুমানিক প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে সৃষ্টি হয়েছে এবং তখন থেকেই মহাবিশ্ব এবং সাথে সাথে মহাকাশ ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের গতি এত বেশি যে, আমরা সম্পূর্ণ মহাবিশ্বের পরিসীমা কখনোই মাপতে পারব না!
আরও পড়ুনঃ রাশিয়ার আয়তন কত? রাশিয়া বাংলাদেশ থেকে কত গুণ বড়?
আমাদের গ্যালাক্সি, মিল্কিওয়ে, যেখানে আমরা বাস করি, তার ব্যাসই প্রায় ১ লাখ আলোকবর্ষ। কিন্তু মহাবিশ্বে আরো এমন অসংখ্য গ্যালাক্সি রয়েছে, যেগুলোর আকার মিল্কিওয়ের তুলনায়ও অনেক অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ বললে, “IC 1101” নামক একটি গ্যালাক্সি, যার ব্যাস প্রায় ৬ মিলিয়ন আলোকবর্ষ!
মহাকাশে কি কি আছে?
খালি চোখে মহাকাশকে এক প্রকার ফাঁকা মনে হলেও, মহাকশে রয়েছে অসংখ্য অগণিত অজানা মহাজাগতিক বস্তুূ। যেমনঃ
- গ্রহ ও উপগ্রহ: শুধু মাত্র আমাদের সৌরজগতেই মোট ৮টি গ্রহ রয়েছে এবং প্রায় ২০০-এর বেশি প্রাকৃতিক উপগ্রহ (চাঁদ) রয়েছে। আর পুরো মহাকাশ জুড়ে আরো ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গ্রহ- উপগ্রহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যেগুলো হয়ত চিরকালই অজানা থেকে যাবে আমাদের!
- নক্ষত্র: মহাবিশ্বে ট্রিলিয়নেরও বেশি নক্ষত্র রয়েছে। আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র হলো সূর্য। সূর্যই আমাদের সৌরজগতের কর্তা এবং পৃথিবী সহ সকল গ্রহ সূর্য থেকেই প্রয়্যোজনীয় শক্তি পায়।
- গ্যালাক্সি: অসংখ্য নক্ষত্র, গ্রহ, ধূলিকণা এবং গ্যাসের সমষ্টিকেই গ্যালাক্সি বলে। জেনে অবাক হবেন, এখনো পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারেই মহাকাশে প্রায় ২ ট্রিলিয়নের বেশি গ্যালাক্সি রয়েছে।
- নেবুলা: নেবুলা মূলত গ্যাস ও ধূলিকণার বিশাল মেঘ, যেখানে প্রতিনয়ত নতুন নতুন নক্ষত্র জন্ম নেয়। আমাদের সূর্যও প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে কোন এক নেবুলা থেকেই সৃষ্টি হয়েছিলো।
- ব্ল্যাক হোল: অনেক বেশি ভর বিশিষ্ট নক্ষত্রের অন্তিম সময়ে নক্ষত্রটি ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ-গহ্বরে পরিণত হয়। ব্ল্যাক হোলে মহাকর্ষ বল এতটাই বেশি হয় যে, আলোও ব্ল্যাক হোল থেকে নিস্তার পায় না!
- ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি: আশ্চর্যজনকভাবে মহাবিশ্বের প্রায় ৯৫% অংশই দখল করে রেখেছে কোন অজানা শক্তি ও পদার্থ যাকে আমরা ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি হিসেবে চিনি। এই ডার্ক এনার্জি ও ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে খুব কম তথ্যই জানা গেছে এখনো পর্যন্ত।
আরও পড়ুনঃ পিরামিড কি? পিরামিডের ভিতরে কি আছে?
ভূপৃষ্ঠ থেকে মহাকাশের দূরত্ব কত?

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগে উঠতে উঠতে এক সময় তা আকাশ থেকে মহাকশে রুপ নেয়, তাই নির্দিষ্টভাবে মহাকাশের শুরু নির্ধারণ করা কঠিন। তবে বিজ্ঞানীরা সাধারণত কারম্যান লাইন (Kármán Line)-কেই মহাকাশের সীমানা হিসেবে বিবেচনা করেন, যা ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) ওপর পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে, বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা মহাকাশের সীমানা ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করে। যেমনঃ NASA ভূপৃষ্ঠ থেকে ৮০ কিলোমিটার (৫০ মাইল) পর্যন্ত উচ্চতাকে মহাকাশের সীমানার শুরু হিসেবে গণ্য করে। আবার ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ESA) এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ সংস্থা (FAI) ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিলোমিটার উচ্চতাকে মহাকাশের সীমানার শুরু হিসেবে বিবেচনা করে।
মহাকাশে কি অভিকর্ষ আছে?
হ্যাঁ, জেনে অবাক হবে, মহাকাশেও মহাকর্ষ (পৃথিবীর ক্ষেত্রে অভিকর্ষ বলে) বল (Gravity) আছে, তবে তা পৃথিবীর পৃষ্ঠের তুলনায় অনেক দুর্বল। যেকোনো মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র থেকে দূরে সরে গেলে ক্রমান্বয়ে মহাকর্ষ বল কমতে থাকে, কিন্তু কখনোই পুরোপুরি শূন্য হয় না?
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, মহাকাশে মহাকর্ষ বল থাকে তাহলে মহাকাশে মানুষ ভাসে কেন? মহাকাশচারীরা আসলে অভিকর্ষের অভাবে নয়, বরং নির্দিষ্ট কক্ষপথে গতিশীল থাকার কারণে ভাসেন। যখন কোনো বস্তু উচ্চ গতিতে পৃথিবীর চারপাশে আবর্তিত হয়, তখন তাকে মুক্তপতন (Free Fall) বলে, এর ফলে মনে হয় তারা শূন্য অভিকর্ষের মধ্যে ভাসছে। এই অবস্থাকেই মাইক্রোগ্রাভিটি (Microgravity) বলা হয়।
আরও পড়ুনঃ মহাদেশ কি ? পৃথিবীতে কয়টি মহাদেশ আছে ?
সবচেয়ে বড় গ্যালাক্সির নাম কি?
আগেই বলা হয়েছে মহাকাশে ছোট বড় অসংখ্য গ্যালাক্সি রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় গ্যালাক্সির নাম হলো “Alcyoneus”।
এক নজরে Alcyoneus গ্যালাক্সির বৈশিষ্ট্য:
- Alcyoneus একটি জায়ান্ট রেডিও গ্যালাক্সি (Giant Radio Galaxy – GRG)।
- এটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।
- Alcyoneus এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬ মিলিয়ন (১.৬ কোটি) আলোকবর্ষ, যা আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির (১ লক্ষ আলোকবর্ষ) তুলনায় প্রায় ১৬০ গুণ বেশি!
মহাকাশের সবচেয়ে ছোট নক্ষত্রের নাম কি?
মহাকাশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে ছোট নক্ষত্রের নাম হলো “EBLM J0555-57Ab”।
এক নজরে EBLM J0555-57Ab নক্ষত্রের বৈশিষ্ট্য:এই নক্ষত্রটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৬০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।
- এর ব্যাস শনি (Saturn) গ্রহের প্রায় সমান।
- নক্ষত্রটি আমাদের সূর্যের তুলনায় ৮৫ গুণ হালকা।
- এর ভর এতটাই কম যে এটাকে একটি বিশাল গ্যাসীয় গ্রহের মতো দেখায়।
- নক্ষত্রটি এখনো জ্বলতে পারছে কারণ এর ভেতরের হাইড্রোজেন ফিউশন (Hydrogen Fusion) বিক্রিয়া এখনো চলছে, ফলে এখনো শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে।
- EBLM J0555-57Ab এর ভর যদি আরেকটু কম হতো, তাহলে এটি নক্ষত্র না হয়ে “বাদামী বামন (Brown Dwarf)” হয়ে যেত।
- আমাদের সূর্য ও অন্যান্য বড় নক্ষত্রের তুলনায় EBLM J0555-57Ab নক্ষত্রটি অনেক ফ্যাকাশে ও কম উজ্জ্বল।
মহাকাশ ও মহাবিশ্ব কি একই?
না, মহাকাশ ও মহাবিশ্ব একই নয়। যদিও আমাদের মধ্যে অনেকেই মহাকাশ এবং মহাবিশ্ব দুটি বিষয়কেই এক মনে করেন। কিন্তু বাস্তবে এদের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। নিচে মহাকাশ ও মহাবিশ্বের পার্থক্য তুলে ধরা হলোঃ
মহাকাশ কি?
- মহাকাশ বলতে মূলত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরের বিশাল শূন্যস্থান বোঝায়, যেখানে অসংখ্য গ্রহ, উপগ্রহ, তারা, গ্যালাক্সি, এবং বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু অবস্থিত।
- এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের শেষ সীমানা থেকে শুরু হয় এবং অসীম দূরত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত।
- মহাকাশে বায়ুর উপস্থিতি না থাকায় সেখানে শূন্য মাধ্যাকর্ষণ বা মাইক্রোগ্রাভিটি পরিস্থিতি অনুভুত হয়।
আরও পড়ুনঃ সেরা ১০ টি কিডনি ভালো রাখার উপায়
মহাবিশ্ব কি?
- মহাবিশ্ব বলতে সমস্ত কিছু বোঝানো হয়, মহাবিশ্বের আওতায় রয়েছেঃ সমস্ত গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, গ্রহ, কৃষ্ণগহ্বর, মহাশূন্য এবং এমনকি সময় ও স্থানও মহাবিশ্বের অন্তর্ভুক্ত।
- মহাবিশ্ব এখনো পর্যন্ত অসীম বা অন্তত।
- মহাবিশ্বের মধ্যে রয়েছে বহু গ্যালাক্সি, যার মধ্যে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিও একটি।
- মহাবিশ্ব একটি মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
শেষ কথা
জ্ঞানী বাবা!’র আজকের আর্টিকেল থেকে পাঠকগণ আশা করি মহাকাশ কি? মহাকাশ কাকে বলে? মহাকাশ কত বড়? সহ সম্পর্কিত অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছেন। জ্ঞানী বাবা!’র আজকের আর্টিকেলটি ভাল লেগে থাকলে পরিচিতদের সাথে সেয়ার করুন আর কমেন্ট করে আপনার মূল্যবান মন্তব্য আমাদের জানাতে ভুলবেন না কিন্তু!!!