টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায় কেন?

আমাদের শরীরের সুস্থতা ও স্বাভাবিক কর্মক্ষমতার পেছনে রয়েছে একাধিক হরমোনের যৌথ ভূমিকা। এদের মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হরমোন হলো টেস্টোস্টেরন। টেস্টোস্টেরন সাধারণত পুরুষদের ক্ষেত্রে অধিকমাত্রায় উৎপন্ন হয়, তবে নারীদের শরীরেও অল্প পরিমাণে থাকে। টেস্টোস্টেরন মূলত যৌন স্বাস্থ্য, পেশিশক্তি, হাড়ের ঘনত্ব, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামগ্রিক শক্তি-সামর্থ্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
জ্ঞানী বাবা!’র আজকের এই লেখায় আমরা টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায় কেন? এই প্রশ্নের উত্তর সহ টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায় কেন? বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা করবো। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!!!
সূচীপত্রঃ
বয়সের কারণে টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায় কেন?

টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায় কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই ধীরে ধীরে টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায় এবং এটিই হওয়ার কথা। এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনেক সময় “Andropause” বলা হয়।
সাধারণত একজন পুরুষের টেস্টোস্টেরনের মাত্রা তরুণ বয়সে সর্বোচ্চ থাকে। কিন্তু ৩০ পেরোলেই প্রতি বছর গড়ে ০.৮% থেকে ১% হারে হরমোনের মাত্রা কমতে শুরু করে। এই হ্রাস প্রক্রিয়াটি এতটাই ধীর ও স্বাভাবিক যে অনেকেই শুরুতে তা বুঝতেই পারেন না। কিন্তু বয়স ৪০–৫০-এর কোটায় পৌঁছানোর পর অনেকেই লক্ষ করেন – আগের মতো শক্তি নেই, আগ্রহ কমে গেছে, পেশির জোর কমে এসেছে বা মানসিকভাবে ক্লান্ত লাগে।
আরও পড়ুনঃ টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যাওয়ার লক্ষণ কী?
এখন প্রশ্ন বয়স বাড়লে টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায় কেন? এই বয়সভিত্তিক হ্রাসের পেছনে কিছু কারণ থাকে, যেমনঃ
- শরীরের কোষগুলো টেস্টোস্টেরন উৎপাদনের দক্ষতা হারায়
- পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে হরমোন-নিয়ন্ত্রণকারী সংকেত দুর্বল হয়ে পড়ে
- দেহের হরমোন রিসেপ্টরগুলোর কার্যকারিতা হ্রাস পায়
এছাড়া বয়সের সাথে অনেকেই নিজের অজান্তেই ওজন বাড়িয়ে ফেলেন, কম সক্রিয় হয়ে যান, এবং নানা ধরণের ওষুধ গ্রহণ শুরু করেন — যেগুলিও টেস্টোস্টেরনের ঘাটতিকে আরও ত্বরান্বিত করে।
টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায় কেন? জীবনযাপনে অবহেলাঃ

বয়স ছাড়াও আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা, অভ্যাস ও খাদ্যাভ্যাস সরাসরি টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। অনেকেই বুঝতেই পারেন না যে তাদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু কাজ বা অবহেলাই ধীরে ধীরে শরীরে এই গুরুত্বপূর্ণ হরমোনের ঘাটতি তৈরি করছে। নিচে এমন কিছু সাধারণ জীবনযাপনসংক্রান্ত কারণ আলোচনা করা হলোঃ
১. অনিয়মিত ঘুম
টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায় কেন? এই প্রশ্নের অন্যতম প্রাসঙ্গিক উত্তর হবে, অনিয়মিত ঘুম। জেনে অবাক হবেন, টেস্টোস্টেরনের বেশিরভাগ নিঃসরণ হয় গভীর ঘুমের সময়, বিশেষ করে রাতের শেষ ভাগে। যদি কেউ পর্যাপ্ত ও গভীর ঘুম না পান, তাহলে শরীরে এই হরমোনের উৎপাদন ব্যাহত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি রাতে ৭–৮ ঘণ্টার কম ঘুম পুরুষদের টেস্টোস্টেরনের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিতে পারে।
২. অতিরিক্ত মানসিক চাপ
দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক চাপ বা উদ্বেগ থাকলে শরীরে কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোন বেড়ে যায়। কর্টিসল সরাসরি টেস্টোস্টেরন উৎপাদনকে দমন করে।
এছাড়া মানসিক চাপের কারণে খাওয়া-দাওয়া ও ঘুমের রুটিন ভেঙে যায়, যা হরমোন ভারসাম্যকে আরও নষ্ট করে।
৩. ব্যায়াম বা শরীরচর্চা না করা
নিয়মিত শরীরচর্চা, বিশেষ করে ওয়েট ট্রেইনিং ও হাই-ইনটেনসিটি এক্সারসাইজ (HIIT), শরীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। অন্যদিকে যারা একেবারেই ব্যায়াম করেন না বা অলস জীবনযাপন করেন, তাদের শরীরে ধীরে ধীরে এই হরমোনের উৎপাদন হ্রাস পায়।
৪. খাদ্যাভ্যাসে ঘাটতি
টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায় কেন? এই প্রশ্নের উত্তর অনেকের জন্যেই হবে, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য অভ্যাস। টেস্টোস্টেরনের সঠিক উৎপাদনের জন্য শরীরকে নির্দিষ্ট কিছু পুষ্টি উপাদান পেতে হয়। যেমনঃ
- জিঙ্ক (Zinc): টেস্টোস্টেরনের প্রধান সহায়ক খনিজ উপাদান
- ভিটামিন ডি (Vitamin D): সূর্যের আলোও একটি ভালো উৎস
- স্বাস্থ্যকর চর্বি (Healthy Fats): বাদাম, অলিভ অয়েল, ডিমের কুসুম ইত্যাদিতে থাকে
৫. অ্যালকোহল ও ধূমপান
অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন করলে লিভার টেস্টোস্টেরন ভেঙে ফেলে, ফলে শরীরে এর ঘাটতি দেখা দেয়। একইভাবে ধূমপান রক্তপ্রবাহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা হরমোন তৈরির প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।
টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায় কেন? স্বাস্থ্যগত কারণঃ
জীবনযাত্রার পাশাপাশি কিছু শারীরিক সমস্যা ও রোগ-ব্যাধিও টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা কমে যাওয়ার জন্য দায়ী হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে হরমোনের ঘাটতি সাধারণত ধীরে ধীরে নয়, বরং তুলনামূলক দ্রুত ঘটে থাকে। অনেক সময় চিকিৎসা ছাড়া এর উন্নতি সম্ভব হয় না। নিচে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যগত কারণ আলোচনা করা হলোঃ
১. স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন
শরীরে অতিরিক্ত চর্বি বিশেষ করে পেটের চর্বি (visceral fat) টেস্টোস্টেরনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ইস্ট্রোজেন নামক নারীদের হরমোন তৈরি করতে শুরু করে। ফলে শরীরে পুরুষদের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন ভারসাম্য নষ্ট হয়। এছাড়া স্থূলতা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের কারণ হতে পারে, যা আবার হরমোন উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
২. ডায়াবেটিস (টাইপ-২)
জেনে অবাক হবেন, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও টেস্টোস্টেরন হ্রাসের মধ্যে একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ও উচ্চ রক্তে শর্করার মাত্রা শরীরের স্বাভাবিক হরমোন নিঃসরণ প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটায়।
৩. হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ
হৃদযন্ত্র এবং রক্তপ্রবাহ সংক্রান্ত সমস্যাগুলিও টেস্টোস্টেরনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। টেস্টোস্টেরন উৎপাদনের জন্য শরীরের রক্তপ্রবাহ ঠিক থাকা জরুরি, কারণ রক্তের মাধ্যমেই হরমোন পরিবাহিত হয় এবং টেস্টিসে পুষ্টি ও সংকেত পৌঁছায়। যদি কারো হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তাহলে এই রক্তপ্রবাহ বিঘ্নিত হয়ে টেস্টোস্টেরন হ্রাস পেতে পারে। তাই হৃদরোগ থাকলে সচেতন থাকুন।
৪. হরমোন সংশ্লিষ্ট গ্রন্থির সমস্যা (Hypogonadism)
হাইপোগোনাডিজম হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীর তার পর্যাপ্ত টেস্টোস্টেরন উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়। এটি দুইভাবে হতে পারে:
- প্রাথমিক হাইপোগোনাডিজম: যেখানে টেস্টিস বা অণ্ডকোষ নিজেই হরমোন তৈরি করতে অক্ষম
- সেকেন্ডারি হাইপোগোনাডিজম: যেখানে মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে হরমোন-নিয়ন্ত্রণ করার সংকেত আসে না
এই ধরনের সমস্যায় সাধারণত চিকিৎসা প্রয়োজন হয় এবং রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সহজে নির্ণয় করা সম্ভব।
৫. দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ সেবন
কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ দীর্ঘদিন সেবন করলে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে যেতে পারে। যেমনঃ
- স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ: যেমন কোর্টিকোস্টেরয়েড
- মানসিক রোগের ওষুধ: অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, অ্যান্টিসাইকোটিক
- কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন থেরাপি: ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়
টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায় কেন? পরিবেশগত কারণঃ

বর্তমান যুগে পরিবেশগত বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব মানুষের শরীরে থাকা হরমোনের ভারসাম্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। বিশেষ করে টেস্টোস্টেরন হরমোনের ক্ষেত্রে, কিছু পরিবেশগত উপাদান শরীরের স্বাভাবিক হরমোন উৎপাদন ও কার্যকারিতা ব্যাহত করতে পারে। এগুলোকে বলা হয় এন্ডোক্রাইন ডিজরাপ্টর কেমিক্যালস (EDCs) বা হরমোন বিঘ্নকারী রাসায়নিক।
১. প্লাস্টিকের ব্যবহার ও BPA (Bisphenol A)
এখনকার দিনে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। খাবারের প্যাকেট, পানির বোতল সহ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই প্লাস্টিকের ব্যবহার দেখা যায়। বেশিরভাগ প্লাস্টিকে থাকে BPA নামক রাসায়নিক, যা শরীরে ঢুকে হরমোনের সঙ্গে মিলে গিয়ে টেস্টোস্টেরনের কাজ কমিয়ে দেয়।
২. কীটনাশক ও রাসায়নিক দ্রব্য
কৃষিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন কীটনাশক, হেরবিসাইড এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থও কোনোভাবে মানবদেহে প্রবেশ করলে হরমোনের নিঃসরণ ও কার্যকারিতায় বিঘ্ন ঘটায়।
বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন এমন পরিবেশে কাজ করছেন, তাদের শরীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায় কেন? জেনেটিক কারণঃ
টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা কমে যাওয়ার পেছনে কখনো কখনো জেনেটিক বা জন্মগত কারণও থাকতে পারে। এই ধরনের সমস্যা সাধারণত তেমন সহজে সমাধান হয় না এবং চিকিৎসকের নজরদারি ও বিশেষ পরামর্শ প্রয়োজন হয় সবসময়।
১. ক্লাইনফেলটার সিনড্রোম (Klinefelter Syndrome)
ক্লাইনফেলটার সিনড্রোম একটি জেনেটিক রোগ, যেখানে পুরুষদের শরীরে অতিরিক্ত এক বা একাধিক X ক্রোমোজোম থাকে (সাধারণত XY এর পরিবর্তে XXY)। এর ফলে তাদের টেস্টিস বা অণ্ডকোষ সঠিকভাবে কাজ করে না এবং টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে যায়। এই অবস্থায় পুরুষরা সাধারণত স্তনের বৃদ্ধি, কম পেশি, উচ্চতা বেশি হওয়া, ও যৌন কমজোরি সমস্যায় ভুগতে পারেন।
২. পিটুইটারি গ্রন্থির সমস্যা
পিটুইটারি গ্রন্থি আমাদের মস্তিষ্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থি, যা শরীরের অন্যান্য গ্রন্থিকে হরমোন নিঃসরণের সংকেত দেয়। জন্মগত ত্রুটি বা অন্য কোনো কারণে যদি পিটুইটারি সঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে টেস্টোস্টেরনের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়।
৩. টেস্টিস বা অণ্ডকোষের গঠনগত ত্রুটি
কখনো কখনো অণ্ডকোষের স্বাভাবিক গঠনগত বিকাশ না হওয়ায় বা আঘাত-প্রাপ্তির ফলে সেখানে টেস্টোস্টেরন উৎপাদন কম হতে পারে। জন্মগত এই ত্রুটি কিংবা পরে আঘাতের কারণেও টেস্টোস্টেরনের মাত্রা হ্রাস পেতে পারে।
আরও পড়ুনঃ রক্তের এলার্জি দূর করার উপায় জেনে নিন
শেষ কথা
জ্ঞানী বাবা!’র আজকের আর্টিকেল “টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায় কেন?” এ আলোচনা করা হয়েছে টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায় কেন?’ এই প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কিত যাবতীয় বিস্তারিত।
আশা করি পাঠক টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যাওয়ার লক্ষণ গুলো জানতে পেরেছেন। যদি আজকের এই লেখাটি পাঠকের একটুও কাজে এসে থাকে, ভাল লেগে থাকে, অনুরোধ করব, আপনার পরিবার-প্রিয়জনদের সাথে লেখাটি শেয়ার করুন। আর কমেন্টে আপনার অনুভুতি জানাতে একদম ভুলবেন না কিন্তু!