ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ কী?

প্রাচীন কাল থেকেই রাজতন্ত্রের ধারণাটি ইতিহাসের পাতায় হাজার হাজার বছর ধরে স্থান করে নিয়েছে। তবে আধুনিক যুগে, যেখানে গণতন্ত্রই অধিকাংশ রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তি, সেখানে এখনো কিছু দেশ রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধরে রেখেছে। এদের মধ্যে অন্যতম ও আলোচিত একটি উদাহরণ হলো ব্রিটেনের রাজতন্ত্র। প্রযুক্তি, চিন্তাভাবনা এবং সামাজিক মূল্যবোধে এত অগ্রসর হওয়া একটি জাতি হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশরা কেন এখনো রাজতন্ত্রকে সমর্থন করে যাচ্ছে? এই প্রশ্ন আমাদের অনেকের মনেই ঘুরপাক খায়।
আধুনিক ইউরোপের অনেক দেশ যখন রাজতন্ত্র পরিত্যাগ করেছে বা সীমিত করেছে অনেক আগ থেকেই, তখন ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ হয়ে উঠেছে একটি গবেষণাযোগ্য একইসাথে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়। ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ কেবল ইতিহাস বা ঐতিহ্যের ব্যাপারই নয়; এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ব্রিটিশ সমাজের সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও জনমানসের আবেগ।
তাই জ্ঞানী বাবা!’র আজকের এই লেখায় আমরা জানার চেষ্টা করব, ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ কী? কেন এখনো ব্রিটেনে রাজপরিবার এত জনপ্রিয়?, কীভাবে তারা নিজেদের আধুনিকতার সাথে রাজতন্ত্র মানিয়ে নিয়েছে? থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রায় সব কিছু! এই সবকিছু মিলিয়ে ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টাই হবে এই লেখার মূল উদ্দেশ্য। তাহলে চলুন, শূরু করা যাক!!!
সূচীপত্রঃ
ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ কী তাহলে?

১. ঐতিহাসিক ভিত্তি
ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো এর শক্তিশালী ঐতিহাসিক ভিত্তি ও ধারাবাহিকতা। ব্রিটেনের রাজতন্ত্র পৃথিবীর প্রাচীনতম কার্যকর রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলোর একটি, যার শিকড় গেঁথে আছে হাজার বছরের ইতিহাসের পাতায়। অ্যাংলো-স্যাক্সন যুগ থেকে শুরু করে টিউডর, স্টুয়ার্ট এবং হ্যানোভারের মতো নানা রাজবংশ পেরিয়ে আজকের আধুনিক রাজপরিবার পর্যন্ত ব্রিটিশ রাজতন্ত্র টিকে আছে ধারাবাহিকভাবে।
এই দীর্ঘ ইতিহাস ব্রিটিশ জনগণের মানসপটে রাজপরিবারকে একটি স্থায়ী ও নির্ভরযোগ্য প্রতীকে পরিণত করেছে। মানুষ রাজতন্ত্রের সঙ্গে তাদের জাতীয় পরিচয়, ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক অনুভব করে। তাই অনেক ব্রিটিশ নাগরিকের কাছে রাজপরিবার কেবল রাষ্ট্রীয় প্রতীক নয়, বরং গর্ব ও আবেগেরও একটি অংশ।
আরও পড়ুনঃ সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে?
তাছাড়া, ইতিহাসে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে যেমনঃ গৃহযুদ্ধ, ধর্মীয় দ্বন্দ্ব, উপনিবেশবাদ, বিশ্বযুদ্ধ, তবু সব পরিস্থিতিতে ব্রিটেনের রাজতন্ত্র নিজেকে অভিযোজিত করে টিকিয়ে রেখেছে। এই টিকে থাকার ক্ষমতা এবং ধারাবাহিক উপস্থিতি রাজতন্ত্রকে একটি শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে সাধারণ মানুষের কাছে। এই ঐতিহাসিক দৃঢ়তা ও দীর্ঘস্থায়ীত্বই আজকের দিনে ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
২. সাংবিধানিক গঠন
ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো এর সাংবিধানিক কাঠামো। ব্রিটেন একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র, যার অর্থ হলো, রাজা বা রাণীর অবস্থান রাষ্ট্রের প্রতীকী প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তব শাসনক্ষমতা পুরোপুরি পার্লামেন্ট ও নির্বাচিত সরকারের হাতে। এই ব্যবস্থায় রাজপরিবারের ভূমিকা সীমিত, নিয়ন্ত্রিত ও মূলত আনুষ্ঠানিক।
এই সীমিত ভূমিকা রাজতন্ত্রকে রাজনৈতিক বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব থেকে দূরে রাখে, ফলে জনগণের চোখে এটি নিরপেক্ষ ও সম্মানযোগ্য একটি প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। রাজা বা রাণী আইন প্রণয়ন করেন না, নীতিনির্ধারণ করেন না, বরং সরকারের পরামর্শে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করেন, যেমন: পার্লামেন্ট উদ্বোধন, বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের স্বাগত জানানো, বা জাতীয় সংকটে সমবেদনা জানানো।
এই কাঠামো রাজতন্ত্রকে জনগণের অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত রাখে, অথচ প্রশাসনিক ব্যর্থতা বা রাজনৈতিক অপদর্শিতার দায় থেকে মুক্ত রাখে। ফলে সময়ের সাথে সাথে সরকারের জনপ্রিয়তা ওঠানামা করলেও রাজতন্ত্র তার স্থির অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এটি ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণের একটি কার্যকর রাজনৈতিক কৌশল।
অন্যদিকে, রাজপরিবার নিয়ম মেনে আইনের অধীনেই কাজ করে, যা আবার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। এই ভারসাম্য ও রাজনৈতিক দূরত্বই রাজতন্ত্রকে আধুনিক ব্রিটিশ সমাজে একটি গ্রহণযোগ্য ও স্থায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে।
এভাবেই সাংবিধানিক কাঠামোর মাধ্যমে রাজতন্ত্র একদিকে যেমন ঐতিহ্য রক্ষা করে, অন্যদিকে তেমনি গণতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখেই টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে। এই দিকটিই ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
৩. গণমাধ্যমের ইতিবাচক চিত্র
আধুনিক বিশ্বের রাজতন্ত্র কেবল ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করে টিকে থাকতে পারে না। এর সঙ্গে প্রয়োজন হয় জনসচেতনতার ইতিবাচক নির্মাণ, যা গণমাধ্যমের সাহায্যে অনেকটাই সম্ভব হয়। ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ হিসেবে গণমাধ্যমে রাজপরিবারের সুপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত উপস্থাপন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
ব্রিটিশ রাজপরিবার গণমাধ্যমের মাধ্যমে নিজেদের এমনভাবে তুলে ধরে, যাতে তারা অনেকটাই আধুনিক, মানবিক ও দায়িত্বশীল বলে প্রতীয়মান হয়। রাজপরিবারের সদস্যদের সামাজিক কাজ, দাতব্য সংস্থায় সম্পৃক্ততা, মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ, এবং বিশ্বজনীন ইস্যুতে অবস্থান গ্রহণ, সবই মিডিয়ায় ইতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয়। প্রিন্সেস ডায়ানার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শুরু করে প্রিন্স উইলিয়াম ও কেট মিডলটনের পারিবারিক মূল্যবোধ, এসব বিষয় রাজপরিবারের ভাবমূর্তি শক্তিশালী করতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছে।
বিশেষ করে টেলিভিশন, সংবাদপত্র এবং সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে রাজপরিবার নিজেদের নিয়মিত দৃশ্যমান রাখে। রাজকীয় বিয়ে, জন্ম, মৃত্যু বা ঐতিহাসিক সফর, সবকিছুই মিডিয়ার সাহায্যে বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়, যা জনমনে আগ্রহ ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে। এই ইতিবাচক মিডিয়া কাভারেজ ব্রিটেনের নাগরিকদের মধ্যে রাজপরিবারের প্রতি একধরনের আবেগ ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করে রাখে।
তদুপরি, মিডিয়া ব্রিটেনের রাজপরিবারকে একটি ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে তুলে ধরেছে, যা ব্রিটেনের জাতীয় পরিচয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। এই ব্র্যান্ডিং পদ্ধতি রাজতন্ত্রকে কেবল ঐতিহাসিক প্রতীক নয়, বরং আধুনিক ব্রিটেনের একটি আকর্ষণীয় উপাদানেও পরিণত করেছে।
সব মিলিয়ে, গণমাধ্যমে রাজপরিবারের কৌশলী ও ইতিবাচক উপস্থাপনও নিঃসন্দেহে ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রেংক সমূহ জেনে নিন
৪. জনসাধারণের আবেগ

ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ কেবল রাজনৈতিক বা সাংবিধানিক দিক থেকেই নয়, বরং এটি গভীরভাবে ব্রিটিশ জনগণের আবেগ, সংস্কৃতি ও জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাজপরিবারটিকে ঘিরে ব্রিটিশদের মাঝে এক ধরনের গর্ব, ভালোবাসা ও ঐতিহ্যবোধ কাজ করে, যা যুগ যুগ ধরে গড়ে উঠেছে।
রাজতন্ত্র ব্রিটেনের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জাতীয়তা—এই তিনের প্রতীক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ যেমন একটি পুরো প্রজন্মের কাছে দায়িত্ব, ধৈর্য ও ঐতিহ্যের মূর্তপ্রতীক ছিলেন, তেমনি বর্তমান রাজা ও রাজপরিবারের সদস্যরাও জনগণের আবেগকে সম্মান দিয়ে নিজেদের উপস্থিতি বজায় রাখছেন। এই আবেগমূলক সংযোগ রাজতন্ত্রকে শুধু রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অংশ নয়, বরং প্রতিটি ব্রিটিশ নাগরিকের আত্মপরিচয়ের অংশে পরিণত করেছে।
ব্রিটেনে জাতীয় উৎসব, বিশেষ দিবস, রাজকীয় বিয়ে বা শিশুর জন্ম—এসব উপলক্ষে যে গণউল্লাস দেখা যায়, তা রাজপরিবারের প্রতি মানুষের ভালোবাসারই প্রমাণ। এমনকি বহু মানুষ রাজপ্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে শুভেচ্ছা জানাতে প্রস্তুত থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই সম্মিলিত আবেগ রাজতন্ত্রকে একটি জীবন্ত, প্রাণবন্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ধরে রাখে।
এছাড়া স্কুলপাঠ্য বই, জাতীয় সংগীত, মুদ্রা, ডাকটিকিট, সর্বত্র রাজতন্ত্রের ছাপ রয়েছে ব্রিটেনে। ফলে ছোটবেলা থেকেই প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে রাজপরিবারের প্রতি সম্মানবোধ গড়ে ওঠে।
৫. অর্থনীতিতে রাজতন্ত্রের অবদান
ব্রিটেনের রাজতন্ত্র শুধু একটি সাংস্কৃতিক বা ঐতিহাসিক প্রতীকই নয়,এটি ব্রিটেনের অর্থনীতিতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে পর্যটন খাতে ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রভাব বিশাল, যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। এই অর্থনৈতিক গুরুত্বও ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ।
প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক যুক্তরাজ্যে আসেন শুধুমাত্র রাজপরিবার সংক্রান্ত দর্শনীয় স্থান, ঐতিহাসিক প্রাসাদ এবং রাজকীয় অনুষ্ঠান দেখার জন্য। বাকিংহাম প্যালেস, উইন্ডসর ক্যাসল, কেনসিংটন প্যালেস কিংবা রাজকীয় গার্ড পরিবর্তনের মত দর্শনীয় আয়োজন পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এসব দর্শনীয় স্থান থেকে সংগ্রহীত টিকিটের দাম, গাইডেড ট্যুর, স্যুভেনির এবং হোটেল-বাণিজ্য, সব মিলিয়ে প্রতিবছর বিলিয়ন পাউন্ডের রাজস্ব আসে দেশের অর্থনীতিতে।
তাছাড়া, রাজপরিবারকে ঘিরে নানা অনুষ্ঠান যেমন রাজকীয় বিয়ে, সিংহাসনাভিষেক, জন্মদিন বা শোক অনুষ্ঠান—এইসব আয়োজন বিশ্বজুড়ে বিপুল আগ্রহ তৈরি করে। এসব আয়োজনে ব্রিটেনের ভ্রমণ ও আতিথেয়তা খাত ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় দেশটির বিপুল প্রচার ঘটে, যা পর্যটনবাজারে ব্রিটেনের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে।
রাজপরিবারের ব্র্যান্ড ভ্যালু এতটাই শক্তিশালী যে, ব্রিটেনের অনেক পণ্যে ‘রয়্যাল ওয়ারেন্ট’ থাকে, যা ঐসব পণ্যের প্রতি মানুষের আস্থা ও চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। এতে দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলোও উপকৃত হয়।
৬. আধুনিকতার সাথে অভিযোজন
ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণগুলোর মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পরিবারটির পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন বা মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। সময় বদলেছে, সমাজ বদলেছে, মানুষের চাহিদা ও মানসিকতাও বদলেছে,আর এই পরিবর্তনের ধারায় রাজতন্ত্রও নিজেকে পরিবর্তন করতে পেরেছে বলেই আজও তা টিকে আছে এবং প্রাসঙ্গিকও রয়েছে।
বিশ শতকেও যেখানে রাজপরিবারটি ছিল সাধারণ মানুষ থেকে অনেকটা দূরে, একবিংশ শতকে তারাই এখন মিডিয়ায় খোলামেলা, জনসাধারণের সাথে ঘনিষ্ঠ এবং অনেক বেশি মানবিক। আজকের রাজপরিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়, জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমে যুক্ত এবং যুবসমাজের সঙ্গেও বেশ সম্পৃক্ত। তারা আগের মতো কেবল আড়ম্বরপূর্ণ রাজকীয়তা নয়, বরং বাস্তবসম্মত ও মানবিক চিত্রও তুলে ধরছে।
উদাহরণস্বরূপ, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ দীর্ঘ রাজত্বকালে প্রযুক্তি, গণমাধ্যম, রাজনীতি ও সামাজিক মূল্যবোধে ব্যাপক পরিবর্তন দেখেছেন এবং নিজের ভূমিকা সেই অনুযায়ী বদলেছেন। একইভাবে বর্তমান রাজা চার্লস তৃতীয় পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই উন্নয়নের মতো আধুনিক ইস্যুতে সোচ্চার, যা আবার তরুণ প্রজন্মের কাছে রাজপরিবারটিকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
এছাড়া রাজপরিবার পারিবারিক সংকট, সমালোচনা এবং বিতর্কের মধ্যেও (যেমন: প্রিন্স হ্যারি ও মেগান ইস্যু) স্থিতিশীলতা বজায় রেখে জনসমক্ষে নিজেদের অবস্থানধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। তারা বুঝে গেছে, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা ছাড়া আজকের দুনিয়ায় রাজতন্ত্রের টিকে থাকা অসম্ভব।
এই নমনীয়তা, সময়োপযোগিতা এবং বিবর্তনের সক্ষমতাই ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ হিসেবে একে করে তুলেছে আধুনিক, প্রাসঙ্গিক।
৭. দানশীলতা ও জনকল্যাণমূলক কাজ
আধুনিক সমাজে গোটা একটা রাজ পরিবারের টিকে থাকার জন্যে কেবল রাজকীয় গৌরব বা ঐতিহাসিক গুরুত্বই যথেষ্ট নয়, জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জনের জন্য দরকার মানবিকতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ। এই ক্ষেত্রে রাজপরিবারের দানশীলতা ও জনকল্যাণমূলক কাজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা নিঃসন্দেহে ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ হিসেবেই কাজ করছে।
ব্রিটিশ রাজপরিবার বহু বছর ধরেই অসংখ্য দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রিন্স উইলিয়াম ও কেট মিডলটন মানসিক স্বাস্থ্য, শিশু কল্যাণ ও গৃহহীনদের সহায়তা নিয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন অনেক দিন ধরেই। রাজা চার্লস তৃতীয় (সাবেক প্রিন্স চার্লস) প্রতিষ্ঠিত “The Prince’s Trust” সংগঠনটি হাজার হাজার তরুণকে কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও উদ্যোক্তা হতে সহায়তা করে যাচ্ছে।
আরও পড়ুনঃ সেরা ৯টি ড্রাগন ফলের উপকারিতা ও অপকারিতা
এছাড়াও, ব্রিটিশ রাজপরিবার পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তন রোধ, স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন এবং যুদ্ধাহত সৈনিকদের পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তারা কেবল দানই করেন না, বরং নিজেরা এসব কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা রক্ষা করেন।
ফলে, ঐতিহ্য ও রাজকীয়তার বাইরেও এই দানশীলতা ও জনকল্যাণমূলক ভূমিকা ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার একটি শক্তিশালী সামাজিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত।
৮. রাজনীতির প্রতি নিরপেক্ষতা

ব্রিটেনের রাজতন্ত্রের টিকে থাকার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ব্রিটেনের রাজপরিবার নিজেদেরকে রাজনৈতিক মতবাদের বাইরে রেখে জাতির ঐক্য ও স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে দাড় করেছে। এটাই ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণগুলোর অন্যতম প্রধান দিক।
রাজপরিবারটি কখনোই রাজনৈতিক বিতর্কে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে না, কিংবা কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষপাতিত্বও করে না। এর ফলে জনগণের নানা রাজনৈতিক মতভেদ থাকা সত্ত্বেও রাজপরিবারের প্রতি সম্মান ও আস্থা বজায় থাকে সবসময়। এই নিরপেক্ষতাই ব্রিটিশ সমাজে একটি ‘একতাবদ্ধতার প্রতীক’ হিসেবে কাজ করে, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
রাজপরিবারের এই স্থিতিশীলতা ও সংহত ভাবমূর্তি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও পরিবর্তনের মধ্যেও জনগণের মনে একটি নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে যখন সরকার পরিবর্তিত হয় বা রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়, তখন রাজতন্ত্র একটি নির্ভরযোগ্য ও স্থায়ী রাষ্ট্রীয় সংস্থার মতো ভূমিকা পালন করে।
এই রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা শুধু জনমত জেতার জন্য নয়, বরং ব্রিটিশ রাজতন্ত্রকে একটি শক্তিশালী এবং স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপায়িত করেছে। এভাবেই ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ হিসেবে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা ও স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।
উপসংহার
ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ এককভাবে কোনো একটি দিক নয়, বরং ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, সাংবিধানিক কাঠামো, গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা, জনসাধারণের আবেগ, অর্থনৈতিক গুরুত্ব, পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন ক্ষমতা, জনকল্যাণমূলক কাজ এবং রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার সমন্বয়ে গঠিত। এই সব কারণ মিলিয়ে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র আজো সমসাময়িক সমাজে প্রাসঙ্গিক ও টেকসই প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিরাজমান।
পরিশেষে এতটুকুই বলব, আশা করি জ্ঞানী বাবা!‘র আজকের এই লেখাটি আপনার ভালো লেগেছে। যদি তাই হয়ে থাকে, আজকের এই লেখাটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে , একটু হলেও উপকারে এসে থাকে তবে অনুরোধ করব, সামাজিক মাধ্যমে এই ব্লগটি শেয়ার করুন। আর কমেন্ট সেকশনে আপনার মূল্যবান মতামত রেখে যেতে একদম ভুলবেন না কিন্তু!!!